ইসরায়েল-ইরানের চলমান যুদ্ধ অষ্টম দিনে পা রেখেছে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও পুনরায় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একদিকে তিনি শান্তির বার্তা দিচ্ছেন, আবার অন্যদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যার হুমকি দিচ্ছেন।
এমনকি ইসরায়েলের সঙ্গে যৌথভাবে সামরিক হামলার কথাও বলছেন—এমন দ্বৈত অবস্থান বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিস্মিত করেছে।
হোয়াইট হাউসের ঘোষণা: সিদ্ধান্ত আসছে দুই সপ্তাহের মধ্যে
গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এই যুদ্ধে অংশ নেবে কি না—সে বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ঘোষণার পর থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক ও সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতির গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মত: নেই কোনো সুসংহত কৌশল
বিশ্লেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, ট্রাম্পের এই ধরনের বিবৃতি প্রমাণ করে যে তার কোনো সুস্পষ্ট কৌশল নেই। বরং তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর চাপের মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলছেন। নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করে আসছেন।
ভিন্নমতও রয়েছে
তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ট্রাম্পের এই কৌশলগত হুমকির উদ্দেশ্য ইরানকে ভয় দেখিয়ে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধে বাধ্য করা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল ইরানিয়ান আমেরিকান কাউন্সিলের সভাপতি জামাল আবদি বলেন, “ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে এমন এক নেতার মতো উপস্থাপন করছেন যিনি যেকোনো সময় অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এ কৌশলে তিনি ইরানকে আতঙ্কিত করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে চাইছেন।”
তিনি আরও বলেন, “এই সমস্ত হুমকি হয়তো ইরানকে অপমান করে সুবিধা আদায়ের কৌশল, নয়তো নেতানিয়াহুর কাছে মাথানত করে সরাসরি যুদ্ধে প্রবেশের পূর্বাভাস।”
ট্রাম্প কি নিজের লক্ষ্য জানেন?
ইরানিয়ান-আমেরিকান বিশ্লেষক নেগার মরতাজাভি বলেন, “ট্রাম্প নিজেরাই জানেন না তিনি কী চান। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি শান্তির বার্তা দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন তৃতীয় একটি বড় যুদ্ধ তার শাসনামলে শুরু হয়েছে।”
তিনি আরো সতর্ক করে বলেন, “ইরান একটি বৃহৎ দেশ, জনসংখ্যা ৯ কোটির বেশি। যদি এই সংঘাতে ইরানি সরকার পতনের দিকে যায়, তাহলে তা ইরাক বা আফগানিস্তানের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে—শুরু হবে গৃহযুদ্ধ, সৃষ্ট হবে শরণার্থী সংকট, এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়বে বিশৃঙ্খলা।”
সাম্প্রতিক হামলার প্রেক্ষাপট
গত সপ্তাহে ইসরায়েল বড় ধরনের বিমান হামলা চালায় ইরানের অভ্যন্তরে। যেদিন ওমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে শান্তি আলোচনার ষষ্ঠ রাউন্ড অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, ঠিক সেদিনই এই হামলা হয়। ইরানের সামরিক, পারমাণবিক, তেল ও আবাসিক স্থাপনায় চালানো ওই হামলায় নিহত হন শতাধিক মানুষ, যাদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক ও রাজনৈতিক নেতা।
ইরান পাল্টা জবাবে শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। এতে ইসরায়েলের অন্তত ২৪ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন।
পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র ‘ফোর্দো’ ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইসরায়েলের পক্ষে সফল হওয়া অসম্ভব। কারণ এই কেন্দ্রটি একটি শক্তিশালী পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত, যেখানে সাধারণ সামরিক হামলায় পৌঁছানো দুরূহ।
মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
মানবাধিকার সংগঠন ডন-এর নির্বাহী পরিচালক সারাহ লিয়া হুইটসন বলেন, “ট্রাম্প কেবল হুমকির মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলে সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে। এই সংঘাত দ্রুতই আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে একটি বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এই যুদ্ধংদেহী বক্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য চরম হুমকি। ট্রাম্পের এ ধরনের অবস্থানই পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে।”
উপসংহার
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের মধ্যে ট্রাম্পের দোদুল্যমান অবস্থান বিশ্ববাসীর জন্য এক ধরণের অনিশ্চয়তার বার্তা দিচ্ছে। শান্তির কথা বললেও তার কার্যকলাপ ও হুমকি-ধামকি যুদ্ধের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা এখন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন—এই টানাপড়েন কেবল মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, না কি তা রূপ নেবে এক নতুন বৈশ্বিক সংঘাতে।
One comment
Pingback: গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ, নারী ও শিশু নিহতের হার দ্বিগুণের বেশ