“ওড়না কেড়ে নিয়ে হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতো, আর বলতো—এখন পর্দা ছুটে গেছে।”
এটা কোনো সিনেমার দৃশ্য নয়, বরং বাস্তবতার এক জ্বলন্ত দলিল। বাংলাদেশে শত শত মানুষ গুম হয়ে যাওয়ার পর ফিরে এসেছেন শরীর ও মনে ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে। কেউ কেউ আর ফিরে আসেননি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে বলপূর্বক গুম, অপহরণ এবং অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ শুধু পরিবারের কান্নায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং এবার উঠে এসেছে সরকারি তদন্ত কমিশনের দাখিল করা রিপোর্টে।
২০২৩ সালের শেষের দিকে প্রকাশিত “Unfolding the Truth: A Structural Diagnosis of Enforced Disappearances in Bangladesh” শিরোনামের রিপোর্টে উঠে এসেছে ২৫৩ জন গুম হওয়া মানুষের জবানবন্দি। এদের কেউ গায়েব ছিলেন ৩৯ দিন, কেউবা ৩৯১ দিন। বন্দিদশায় তারা টিকে ছিলেন টর্চার সেলের অন্ধকার গুহায়, যেখানে প্রতিদিনই ছিল নতুন এক বিভীষিকা।
নির্যাতনের ভয়াবহতা: টর্চার সেলের নির্মম বাস্তবতা
টর্চার সেলগুলো ছিল গোপন, সাউন্ডপ্রুফ ঘর, যার ভেতরে বসানো ছিল ঘূর্ণায়মান চেয়ার, লোহার পুলি সিস্টেম এবং বৈদ্যুতিক শক দেবার যন্ত্র। দিনের পর দিন সেখানে চলত নির্যাতন—জোর করে ঝুলিয়ে রাখা, হাত-পা বেঁধে ছাদ থেকে নামিয়ে দেওয়া, ওয়াটারবোর্ডিং, বেত দিয়ে পেটানো, পায়ের নিচে বাঁশ রেখে চাপ দেওয়া।
এক যুবক বলেন—“শরীরের চামড়া ফেটে রক্ত বের হয়ে যেত, নখ তুলে ফেলা হতো, এমনকি নিজ শরীরের পোড়া মাংসের গন্ধও পেতাম।”
নারীদের বিরুদ্ধে ‘বিশেষ’ সহিংসতা
এই প্রতিবেদনে নারীদের উপর চালানো নিপীড়নের বিবরণ যেন কল্পনাতীত। ২০১৮ সালে গুম হওয়া এক নারী বলেন, “আমাদের ওড়না কেড়ে নেওয়া হতো, জানালার দিকে মুখ করে ঝুলিয়ে রাখত যাতে পুরুষরা দেখতে পারে। আমরা বলতাম—প্যাড দরকার, ওরা সেটা নিয়েও হাসাহাসি করত।”
‘বাঁশডলা’, ফ্যানের হুক, উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা—কোথায় থামবে নির্যাতন?
২০১৭ সালে র্যাব-১০ কর্তৃক গুম হওয়া আরেক যুবক বলেন, “ঘাড়ের নিচে ও পায়ের ওপর বাঁশ রেখে আমাকে শুইয়ে রাখত। এরপর একজন বলে ওঠে, ‘বড় স্যার আসছেন।’ কিছুক্ষণ পর বলে, ‘এই উঠ’। আর মনে হলো, গোস্ত ছিঁড়ে নিচ্ছে।”
২০১৭ সালে র্যাব-১১ কর্তৃক অপহৃত এক বৃদ্ধকে টর্চার করে আঙুলের নখ তুলে ফেলা হয়।
একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, তাদের ঘুমাতেও দেওয়া হতো না। শীতে কম্বল কেঁড়ে নেওয়া, প্যান-টয়লেটের ওপর শোওয়ার মতো ব্যবস্থা ছিল।
টয়লেটেও ছিল অপমান: নজরদারি চলত সিসিটিভিতে
সেলগুলো এতটাই ছোট ছিল যে শুয়ে থাকলেই শরীর পড়ে যেত মল-মূত্রময় প্যানের ওপর। ছিল না কোনো পর্দা বা দেয়াল। প্রতিটি মুহূর্ত নজরে রাখত ক্যামেরা। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার সময়ও মর্যাদা রক্ষা করা যেত না।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি
ভুক্তভোগীরা যখন আদালতে আসতেন, তখনও নির্যাতনের চিহ্ন অনেক সময় স্পষ্ট থাকত। তবুও অনেক বিচারক তা উপেক্ষা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরিবারের দুঃস্বপ্ন: গুম মানে শুধু একজনের না থাকা নয়
প্রতিটি গুম একটি পরিবারের জন্য ভয়াল মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানদের স্কুল বন্ধ হয়ে যায়, আয় বন্ধ হয়ে যায়, সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়।
নতুন আশা: তদন্ত কমিশনের উদ্যোগ
২০২৩ সালে গঠিত হয় ‘দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’। তারা শত শত অভিযোগ তদন্ত করে এ রিপোর্ট তৈরি করেছে। ভুক্তভোগীরা আশা করছেন—এই নিপীড়নের বিচার একদিন হবে।
উপসংহার
গুম একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। এর বিরুদ্ধে শুধু শোক ও প্রতিবাদ নয়, প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা। এই ভয়াল চিত্র আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাষ্ট্রের যেকোনো বাহিনী যখন নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন না করে, বরং উল্টো নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন সেটি শুধু আইন-শৃঙ্খলার ব্যর্থতা নয়, বরং নৈতিক ও মানবিক চরম অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি।